ত্বকের যত্ন, বিউটি টিপস

ল্যাকটিক অ্যাসিড ত্বকের যত্নে সুবিধা ও সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া

ল্যাকটিক অ্যাসিড ত্বকের যত্নে সুবিধা ও সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া

 

পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া না জেনেই ল্যাকটিক অ্যাসিড ব্যবহার করছেন? জানুন সম্পূর্ণ গাইড

ত্বকের যত্নে আজকাল যে কয়েকটি উপাদান সবচেয়ে বেশি আলোচিত, তার মধ্যে ল্যাকটিক অ্যাসিড অন্যতম। একে অনেকেই অলৌকিক উপাদান বলে মনে করেন কারণ এটি ত্বককে করে তোলে কোমল, মসৃণ ও উজ্জ্বল।
কিন্তু আপনি কি জানেন—যে উপাদানটি ত্বকের জন্য এত উপকারী, সেটি সঠিকভাবে ব্যবহার না করলে ত্বকে উল্টো সমস্যা তৈরি করতে পারে?
তাহলে চলুন জেনে নেওয়া যাক—

  • ল্যাকটিক অ্যাসিড আসলে কী?
  • এটি কীভাবে কাজ করে?
  • এর উপকারিতা কী কী?
  • সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কী?
  • ব্যবহারের আগে কী সতর্কতা নেওয়া উচিত?

এই আর্টিকেলটি পড়ার পর আপনি বুঝতে পারবেন, ল্যাকটিক অ্যাসিড আপনার ত্বকের জন্য কতটা কার্যকর এবং কিভাবে সঠিকভাবে ব্যবহার করলে এর সর্বোচ্চ উপকার পাবেন।

ল্যাকটিক অ্যাসিড কী?

ল্যাকটিক অ্যাসিড হলো আলফা হাইড্রক্সি অ্যাসিড (AHA) পরিবারের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। প্রাকৃতিকভাবে এটি পাওয়া যায় দুধ, দই এবং বিভিন্ন দুগ্ধজাত খাবারে। প্রাচীনকালেও মানুষ দই বা দুধের ফেসপ্যাক ব্যবহার করত ত্বক উজ্জ্বল ও কোমল রাখার জন্য। আধুনিক কসমেটিক ইন্ডাস্ট্রিতে ল্যাকটিক অ্যাসিড ল্যাবরেটরিতে প্রস্তুত করে ত্বকের উপযোগী করে প্রক্রিয়াজাত করা হয় এবং যুক্ত করা হয় বিভিন্ন পণ্যে যেমন—

  • ক্লেনজার
  • এক্সফোলিয়েটর
  • সিরাম
  • পিলিং সলিউশন
  • ক্রিম বা লোশন

এটি একটি মাইল্ড এক্সফোলিয়েটর—মানে ত্বকের ওপরের মৃত কোষগুলোকে ধীরে ধীরে সরিয়ে নতুন কোষের জন্মে সাহায্য করে।

ল্যাকটিক অ্যাসিড কীভাবে কাজ করে?

আমাদের ত্বকের সবচেয়ে উপরের স্তরটি মৃত কোষ দিয়ে তৈরি। এই মৃত কোষের স্তর কখনও কখনও পুরু হয়ে যায় এবং ত্বক নিস্তেজ দেখায়, পোরস বন্ধ হয়ে ব্রণ সৃষ্টি হয়। ল্যাকটিক অ্যাসিড ধীরে ধীরে এই মৃত কোষের স্তরকে নরম করে ও আলগা করে দেয়। ফলে সেই মৃত কোষগুলো সহজেই ঝরে যায় এবং নতুন কোষের উদ্ভব ঘটে।

এর পাশাপাশি ল্যাকটিক অ্যাসিডের রয়েছে হিউমেকট্যান্ট প্রপার্টি, অর্থাৎ এটি ত্বকের ভেতরে আর্দ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করে। এজন্য এটি শুষ্ক ত্বকের জন্যও উপকারী।

ল্যাকটিক অ্যাসিডের উপকারিতা

১. ত্বকের মৃত কোষ দূর করা

মৃদু কিন্তু কার্যকর এক্সফোলিয়েটিং বৈশিষ্ট্য থাকার কারণে এটি ত্বকের ওপরের স্তরের মৃত কোষ সরিয়ে দেয়। এর ফলে—

  • ত্বক হয় উজ্জ্বল
  • ত্বকের টেক্সচার মসৃণ হয়

২. বলিরেখা ও ফাইন লাইন কমানো

নিয়মিত ব্যবহারে এটি সেল টার্নওভার বাড়িয়ে ত্বকের ইলাস্টিসিটি বাড়ায় এবং বলিরেখা, ফাইন লাইন হালকা করে।

৩. ত্বকের আর্দ্রতা বৃদ্ধি

এটি ত্বকে আর্দ্রতা ধরে রাখে। ফলে—

  • শুষ্ক ত্বক কোমল হয়
  • টান টান ভাব কমে

৪. পিগমেন্টেশন ও দাগ কমানো

হালকা পিগমেন্টেশন বা ব্রণের দাগ ধীরে ধীরে হালকা করতে সাহায্য করে।

ল্যাকটিক অ্যাসিড ব্যবহারের আগে যা যা মাথায় রাখবেন

নতুন ব্যবহারকারী হলে শুরু করুন ধীরে ধীরে।

  • প্রথমে সপ্তাহে ১–২ দিন ব্যবহার করুন।
  • ৫% বা তার নিচের কনসেন্ট্রেশন দিয়ে শুরু করুন।
  • ত্বক মানিয়ে গেলে ধীরে ধীরে সপ্তাহে ৩–৪ দিন করতে পারেন।

ল্যাকটিক অ্যাসিডের সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া

ত্বকের জন্য উপকারী হলেও, এটি একটি সক্রিয় উপাদান। ভুলভাবে ব্যবহার করলে বা অতিরিক্ত ব্যবহার করলে কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে।

১. সান সেনসিটিভিটি

এক্সফোলিয়েশন ত্বকের ওপরের সুরক্ষামূলক স্তর কিছুটা কমিয়ে দেয়। ফলে সূর্যের UV রশ্মি সহজেই ত্বকে প্রভাব ফেলতে পারে।
সমাধান:

  • দিনের বেলায় অবশ্যই SPF ৩০ বা তার বেশি সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন।
  • নিয়মিত রি-অ্যাপ্লাই করুন।

২. ত্বকে ইরিটেশন

প্রথমদিকে ত্বকে কিছুটা জ্বালা বা লালচেভাব দেখা দিতে পারে।
সমাধান:

  • প্রথম ব্যবহারের আগে প্যাচ টেস্ট করুন।
  • যদি লালচেভাব হালকা হয় এবং কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সেরে যায়, তবে ধীরে ধীরে ব্যবহার চালিয়ে যেতে পারেন।
  • ত্বক যদি তীব্রভাবে জ্বলে বা পিলিং হয়, তবে ব্যবহার বন্ধ করুন।

৩. অন্য অ্যাকটিভের সাথে কনফ্লিক্ট

রেটিনল, ট্রেটিনয়েন বা ভিটামিন সি এর সাথে একসাথে ব্যবহার করলে ত্বক অতিরিক্ত সেনসিটিভ হয়ে যেতে পারে।
সমাধান:

  • এই অ্যাকটিভগুলো যেদিন ব্যবহার করবেন, সেদিন ল্যাকটিক অ্যাসিড ব্যবহার করবেন না।
  • একদিন পরপর ব্যবহার করতে পারেন।

৪. অতিরিক্ত পারসেন্টেজ ব্যবহার

বিগিনাররা যদি হাই কনসেন্ট্রেশনের (যেমন ৩০% বা তার বেশি) ল্যাকটিক অ্যাসিড ব্যবহার করেন, তাহলে ত্বকে জ্বালাপোড়া, পিলিং, অতিরিক্ত শুষ্কতা দেখা দিতে পারে।
সমাধান:

  • সর্বদা লো কনসেন্ট্রেশন দিয়ে শুরু করুন।
  • ডার্মাটোলজিস্টের পরামর্শ ছাড়া হাই কনসেন্ট্রেশন ব্যবহার করবেন না।

কারা ল্যাকটিক অ্যাসিড ব্যবহার করতে পারবেন?

ত্বকের ধরন ব্যবহার উপযোগিতা
তৈলাক্ত ত্বক হালকা এক্সফোলিয়েশন ও পোরস ক্লিন রাখতে ভালো
শুষ্ক ত্বক আর্দ্রতা বৃদ্ধির জন্য উপকারী
সেনসিটিভ ত্বক খুব অল্প পরিমাণে ও কম কনসেন্ট্রেশন থেকে শুরু করতে হবে
অ্যাকনে-প্রবণ ত্বক ডার্মাটোলজিস্টের পরামর্শ নিয়ে ব্যবহার করা ভালো

ব্যবহারের আগে যা যা করবেন

  • প্যাচ টেস্ট: প্রথমে হাতে বা কানের পেছনে সামান্য ব্যবহার করে দেখুন।
  • পর্যাপ্ত হাইড্রেশন: এক্সফোলিয়েশনের পর ত্বক আর্দ্র রাখার জন্য ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করুন।
  • অথেনটিক প্রোডাক্ট ব্যবহার করুন: নকল বা মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য ত্বকের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে।

সঠিক ব্যবহারের উদাহরণ

রাতের রুটিন:
১. মৃদু ক্লেনজার দিয়ে মুখ ধুয়ে নিন।
২. তোয়ালে দিয়ে আলতো করে মুছে নিন।
৩. ল্যাকটিক অ্যাসিড যুক্ত সিরাম বা লোশন হালকাভাবে লাগান।
৪. হালকা ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করুন।

দিনের রুটিন:
১. সকালের মৃদু ক্লেনজার ব্যবহার করুন।
২. হালকা ময়েশ্চারাইজার দিন।
৩. SPF ৩০+ সানস্ক্রিন লাগান।

কেন প্যাচ টেস্ট করা জরুরি?

কারণ প্রতিটি ত্বক আলাদা। কারও জন্য উপকারী কিছু অন্যের ত্বকে ইরিটেশন সৃষ্টি করতে পারে।
প্যাচ টেস্টের পদ্ধতি:

  • সামান্য পণ্য হাতে বা কানের পেছনে লাগান।
  • ২৪ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণ করুন।
  • কোনো ইরিটেশন না হলে মুখে ব্যবহার করতে পারেন।

ল্যাকটিক অ্যাসিড কেনার সময় কী দেখবেন?

  • প্রোডাক্টের লেবেল ভালোভাবে পড়ুন।
  • কনসেন্ট্রেশন চেক করুন।
  • প্রোডাক্ট রিভিউ পড়ে সিদ্ধান্ত নিন।
  • অথরাইজড স্টোর বা নির্ভরযোগ্য অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে কিনুন।

ল্যাকটিক অ্যাসিড ত্বকের জন্য সত্যিই একটি অসাধারণ উপাদান। এটি ত্বকের মৃত কোষ সরিয়ে নতুন উজ্জ্বল ত্বক বের করে আনে, আর্দ্রতা ধরে রাখে, পিগমেন্টেশন ও ফাইন লাইন কমাতে সাহায্য করে।
তবে ভুলভাবে ব্যবহার করলে ত্বকে হতে পারে জ্বালা, শুষ্কতা, এমনকি পিগমেন্টেশন বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকিও থাকে।

তাই মনে রাখবেন—

  • ধীরে ধীরে ব্যবহার শুরু করুন।
  • সানস্ক্রিন ব্যবহার করতে ভুলবেন না।
  • প্যাচ টেস্ট না করে নতুন কিছু ব্যবহার করবেন না।
  • অন্য অ্যাকটিভের সাথে একসাথে ব্যবহার করবেন না।

নিজের ত্বকের ধরন বুঝে, ধীরে ধীরে রুটিনে ল্যাকটিক অ্যাসিড অন্তর্ভুক্ত করুন। আর যে কোনো সমস্যা হলে দেরি না করে একজন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। তবেই এই উপাদান আপনাকে দেবে স্বাস্থ্যোজ্জ্বল, কোমল ও দ্যুতিময় ত্বক।